গল্প
ছোটগল্প (ভাঙা ছাতা)
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
![]() |
ভাঙা ছাতা |
-আমির হামজা
অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে, আমি কোন এক অচেনা দোকানের বাড়ন্ত টিনের চালের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। বাড়িতে শিলা একা, আজকে আমাকে জলদি যেতে বলেছিল। সঙ্গেও বলেছিল, “আজ বোধহয় বৃষ্টি হবে, তুমি না হয় ছাতা নিয়ে যাও।” মূলত না বললে আমি ছাতা নিয়ে আসতাম। কিন্তু আমি আমার ছাতাটা হারিয়ে ফেলেছি, আর বাসায় আছে শিলার ছাতা—স্বভাবতই মেয়েলি ছাতা। তাই, লোকে কি বলবে আর ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবে সেই আশঙ্কায়, ওর ছাতা নিয়ে বেরোয়নি। বাসায় গেলে, ছাতা নিয়ে এক দফা কথা শুনতে হবে। আমি বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে এই কথাই ভাবছি। আরো ভাবছি এই বৃষ্টিরই এতদিনে শিলার সঙ্গে আমার পরিচয়। কিছুক্ষণ আগে ফোনেরও চার্জ শেষ হয়ে গেছে, ভাই আর নেটওয়ার্ক ব্রাউজিংও করতে পারছি না।
এক বৃষ্টির দিনে, শুধু বৃষ্টি না, তীব্র বৃষ্টির দিনে, আমি এরকমই এক চাল দেওয়া দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। নিম্নে এক ঘণ্টা ধরে বৃষ্টি হচ্ছে, এই শহরে আধা ঘণ্টা বৃষ্টি হলে আশেপাশের মূল সড়কে হাঁটু পর্যন্ত পানি যায়। আমি কলেজ শেষ করে তীব্র বৃষ্টির মধ্যে আটকা পড়ে গেছি। ডানে ফিরতেই দেখতে পেলাম, একটি মেয়ে বৃষ্টি সহ দমকা হাওয়ায়, ছাতা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ছাতা ঠিক করতে করতেই হিমশিম খাচ্ছে। আমি আগ্রহ নিয়ে, মেয়েদের উলটে যাওয়া ছাতা ঠিক করা দেখছি। এতক্ষণ বৃষ্টি দেখছিলাম, ঠিক করতে করতে মেয়েটি এগিয়ে আসছিল। আশেপাশে কোনো লোকজন নেই, বৃষ্টি দেখে সবাই আগেই চম্পট দিয়েছে। রিকশা ওয়ালারা সবাই রিকশা রেখে যে যার মতন ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আর যারা গাড়ি চালাচ্ছে, তারা ফুল স্প্রিডে চালাচ্ছে, একবার পানি জমে গেলে আর বাসায় ফিরতে পারবে না। তো মেয়েটিও এগিয়ে আসছে, আমিও তাকিয়ে আছি। এতক্ষণ ছাতা ঠিক করতে করতে মেয়েটি আমার থেকেও বেশি ভিজে গেছে। আমি মনে মনে হাসছি, তবে প্রকাশ্যে হাসতে পারছি না।
এমন এক সময়, আমার হাসির সম্পূর্ণ খোরাক জুগিয়ে এই বৃষ্টিতে একেবারে ভিজা ফুটপাতেই গেল পড়ে। মানে শুধু পড়া না, কাদায় পরা। আমি তাকিয়েই আছি। এখনো সাহায্যের জন্যে যাইনি মেয়ে মানুষ বলে। দেখি মেয়েটি উঠার চেষ্টা করে আরো বেশি পরে যাচ্ছে। কাদায় পানিতে লুটোপুটি অবস্থা। আমি জোরে হেঁটে এগিয়ে গেলাম। অনেকটা সংকোচ করে শেষে মেয়েটার ঊর্ধবাহু ধরে এক ঝটকায় টেনে তুললাম, এর পরে পাশে পরে থাকা ডাঁটি ভাঙা ছাতাটি উঠিয়ে নিয়ে বললাম, “আমার সঙ্গে আসুন। আপনি তো দেখছি বাংলার প্রাচীন বিয়ে বাড়ির আয়োজনের মতন স্বাচ্ছন্দ্যে কাদায় লুটোপুটি খাচ্ছেন।”
মেয়েটা কিছু বুঝতে পারেনি, কিংবা আমার কথা শুনতেই পায়নি। আমি তার হাত ছেড়ে দিয়ে বললাম, “দুঃখিত।” ওকে ছাউনির নিচে নিয়ে আসতেই মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে কান্না শুরু করে দিলো। অত্যন্ত হাস্যকর পরিস্থিতি, আমি কি করবো এখনো বুঝতে পারছি না। তো ওর গায়ে অনেক কাদা লেগে ছিল। পোশাকেও আমি ব্যাগ থেকে পানি বের করে দিলাম। তখন মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমার গিফট।”
আমি তাকিয়ে আছি দেখতে, মেয়েটা যেখানে পড়ে গিয়েছিল সেইখানে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। দেখলাম যেখানে ও পড়েছিল চিহ্ন এখনো আছে। ঠিক তার পাশে বৃষ্টিতে ভিজছে একটা রঙিন পেপারে মোড়ানো কোনো কিছু। মেয়েটা সেইদিকে আঙুল উঁচিয়ে আছে দেখতে আমি আবার ওইখানে গেলাম জিনিসটা আনতে। এনে দেখি, এখন কান্না থামিয়ে যেখানে যেখানে কাদা লেগেছে সেইখানে সেইখানে পানি দিয়ে ধুচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে আমার কেনো যেন হাসি পাচ্ছে। আমি ওর গিফট র্যাপারে জড়ানো বস্তুটা ধরে দাঁড়িয়ে আছি, সম্ভবত কোনো বই কিংবা ডায়রি। উপরে কাগজ লাগিয়ে কিছু একটা লিখা ছিল, এখন আর দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে। আর দোকানের শাটারে হেলান দেওয়া আমার ব্যাগ। আমিও এখন কাকভেজা। কপাল থেকে থুতনি পর্যন্ত মেয়েটা কাদা ধুয়ে ফেললো। এইবার তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটা সুন্দর, অনেকটাই সুন্দর। শ্যামলা গায়ের রং, চোখ দুইটা অনেকটা টানাটানা। যখন কান্না করছিলো, মুখের ভাঁজে চোখ বুঝতে পারিনি, এইবার চোখ দেখে ধাক্কার মতন খেলাম। ওর বৃষ্টির মধ্যে বোতলের পানিতে সম্পূর্ণ কাদা গেলো না। আমি বললাম, “আপনি গিফট ধরুন, আমি চালের নিংড়ানো পানি বোতলে ভরে দিচ্ছি।” মেয়েটা এইবার স্বাভাবিক ভাবে কান্নাবিহীন ভাবে বলল, “আমি ভরছি।” এরপরে ধোয়া মোছা পর্ব শেষ করলো। ততক্ষণে বৃষ্টি অনেকটা কমে এসেছে। আমি অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে রেখেছি।
মেয়েটা হুট করে বলল, “জানেন, এইটা আমার সবচেয়ে প্রিয় জামা।” আমি কিছু বললাম না। মেয়েটা আবার বললো, “তখন আমাকে নিয়ে আসার সময় কি বলছিলেন?” আমি বললাম, “ও কিছু না।” মেয়েটা বলল, “যদি বলেন তাহলে আমি কেনো এই বৃষ্টিতে বাইরে বেরিয়েছিলাম সেইটা বলবো।” এইবার আমার আগ্রহের পালা, আমাকে শুনতেই হবে মেয়েটা কেনো এই বৃষ্টির মধ্যে এই দুর্যোগে সেজেগুজে বাহিরে প্রিয় পোশাক পরে বেরিয়েছে। আমি বললাম, “আগে বাংলায় মেয়েদের বিয়েতে মাটির উঠানে পানি ঢেলে কাদা করা হতো। তো ওই উঠানে একে একে সবাইকে ধরে কাদায় গড়াগড়ি পারানো হতো। মাঝে মাঝে তো বরপক্ষের লোকদেরকেও ধরে ফেলে দেওয়া হতো। এইটা গ্রামের ঐতিহ্য ছিল। তো আপনাকে পড়ে লুটোপুটি খেতে দেখে আমার সেই কথাই মনে হচ্ছিল।” এতক্ষণ কথা বলার সময় আমি হাতে ধরে রাখা জিনিসটার দিকে তাকিয়েছিলাম। এইবার মেয়েটার দিকে তাকাতেই ভয় পেলাম, এমনিতেই টানাটানা চোখ, এইবার বোধহয় রাগে আরো টানাটানা হয়ে গেছে। আমি তাই সাফাই গেয়ে বললাম, “আমি কিন্তু মজা করে বলেছিলাম।”
এরপরে হাতে ধরে রাখা জিনিসটা মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিতেই বলল, “ওইটা আপনিই রেখে দিন। আজকে আর জন্মদিনে যাওয়া হবে না। এইভাবে তো আরও না। আমাকে টেনে তোলার জন্যে এই বই এখন আপনার। আমি যাচ্ছিলাম আমার বেস্টফ্রেন্ড এর বাসায়, হুট করে বৃষ্টি চলে আসলো। ১০ মিনিটের রাস্তা, কোনো রিকশাওয়ালা যাবে না। তাই নিজেই হেঁটে রওনা দিয়েছিলাম। পথিমধ্যে এই কাণ্ড। আমি ওকে আরেকটা গিফট পরে কিনে দিব। আপনি বরং আমাকে বৃষ্টি কমলে একটা রিকশা ডেকে এনে দিন, আমি বাড়ি যাবো। আজকের মতন যথেষ্ট হয়েছে। এবং আপনার অপমানও শুনতে হয়েছে।”
আমি বললাম, “এ মা না না, আমি লুটোপুটি খাওয়া অপমান করে বলিনি।” বলতে বলতেই এইবার হেসে ফেলেছি। মেয়েটা আরো চোখ বুলিয়ে বলল, “তা তো বুঝাই যায়।” আমি আর কিছু বললাম না। আজকের মতন যথেষ্ট বলে ফেলেছি। এর পরে বৃষ্টি থামলে আমি রিকশা ডেকে আনলাম। মেয়েটা রিকশাওয়ালাকে কোথায় যাবে সেই ঠিকানা বলে, ওই সময় আমি বলি, “দাঁড়ান দাঁড়ান। এই নিন, আপনার ঐতিহাসিক দিনের সাক্ষ্য হিসেবে ছাতা।” মেয়েটা এইবার প্রথম হাসলো, আর আমি সেই হাসি দেখে ওর ভাঙ্গা ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মেয়েটা রিকশাওয়ালাকে বলল, “মামা যান তো। আর ছাতাটা আপনিই রাখুন।”
আমি ছাতাটা ব্যাগে ঢুকালাম। সেই ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গিফট র্যাপারটা খুললাম।ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের ‘বৃষ্টি বিলাস’। আমি মনে মনে মুচকি হাসলাম। ভাবলাম হায়রে দিন। এরপর বইয়ের মধ্যে নাক ডুবিয়ে নতুন বইয়ের গন্ধ মস্তিষ্কে জমা করে রাখলাম। বইটার একেবারে শেষের পৃষ্ঠায় লেখা, “তনুকে, আমার একমাত্র সখা। -শিলা।”
এর পরে মেয়েটা কীভাবে এত বছর পরে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তার ছাতা আমাকে নিতে বলল? আসুন, সেটা দেখা যাক। মূলত মেয়েটা রিকশাওয়ালাকে যখন ওর বাড়ির ঠিকানা বলে, আমিও তখন সেই ঠিকানা মস্তিষ্কে টুকে রেখেছিলাম। কী উছিলায় যাবো, সেইটাও মেয়েটা আমাকে দিয়ে দিলো। পরের দিন দুপুরে আমি আর নিলয় মিলে এক ছাতার দোকান থেকে ছাতাটায় নতুন ডাঁটি লাগিয়ে মেয়ের কথামতো ঠিকানায় হাজির। এর পরের কাহিনি পুরোটাই ইতিহাস—ভাঙা ছাতা থেকে আমার ঘরের ছাতা হয়ে আসলো শিলা। ছাতার মতোই আমার গায়ে কোনো জলের ফোঁটা এতদিনে পড়তে দেয়নি, নিজেই সব গুছিয়ে রেখেছে।
আমি এতক্ষণ আমাদের প্রথম কীভাবে দেখা হয়েছিল, সেই কথাই ভাবছিলাম। ভাবনার মধ্যে হারিয়ে গেছি। পাশে থেকে হঠাৎ সেই পরিচিত কণ্ঠ, যা প্রথম শুনেছিলাম এক মেয়ের কণ্ঠে বৃষ্টিতে পড়ে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠ। চমকে তাকাতেই দেখি শিলা। আমি বললাম, “তুমি?’’ শিলা বলল, ‘ফোনে শেষ কী বলেছিলে মনে আছে?”
“আছে তো, আমি যে বৃষ্টিতে এইখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেটা বলেছিলাম।”
বলল, “তাই তো আমার মেয়েলি ছাতা নিয়ে তোমাকে উদ্ধার করতে চলে এলাম। এবার লক্ষ্মী ছেলের মতন ছাতাটা হাতে নিয়ে আমাকে ছাতার নিচে নিয়ে বাড়ি ফিরে আমাকে উদ্ধার করো।”
আমি ভাবছি, বৃষ্টিতে আটকা পড়েছি বলে মেয়েটা আমাকে নিতে হেঁটে হেঁটে চলে এসেছে। নিজের জন্যে অনেকটা গর্ব হচ্ছিল। বলল, “দেখো তো পানি শুকিয়ে চটচট করছে। আজ খালি জড় বাঁধাও, দেখ কী হয়।”
আমি বললাম, “যাবো না।”
“কেন যাবে না?”
“তুমি যা রেগে আছো, ছাতা না নেওয়ার জন্যে শেষে আমাকে একেবারে কথা শুনিয়ে মারবে। এর চেয়ে বরং এই ছাউনির নিচে সন্ন্যাস নেওয়া ভালো।”
শিলা বলল, “আচ্ছা, আমি কিছু বলবো না। পাক্কা প্রমিজ, এবার বাড়ি চলো। খিচুড়ি রান্না করা শেষ, হাঁসের মাংস চুলায় চাপাবো।”
আমি তড়িঘড়ি ছাতা ওর হাত থেকে নিয়ে এক হাতে ছাতা, আরেক হাতে ওর উল্টোদিকের কাঁধ ধরে আমার দিকে চেপে ধরে, ওর মেয়েলি ছাতার নিচে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি থেমে যাবে। বাসায় হাঁসের মাংস রান্না হবে, জলদি জলদি যাওয়াই শ্রেয়।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনবাবরে ওয়েবসাইটও খুলে ফেলেছেন?!!
মুছুনসাব্বাস!! চালিয়ে যান। 🖤